ওষুধের আরোগ্যকারী ক্ষমতার বিকাশ ঘটানো এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত করার উপায় সমুহ

(ক) এ্যাটেনুয়েশন বা লঘুকরণ
(খ) বিষাক্ত ওষুধের সুস্বাদুকরণ
(গ) ইনজেকশনের পরিবর্তে মুখে খাইয়ে ওষুধ প্রয়োগ পদ্ধতি

(ক) এ্যাটেনুয়েশন বা লঘুকরণ : আদিকাল থেকে প্রতিটি চিকিৎসা পদ্ধতিতে যত ওষুধ ব্যবহৃত হয়ে আসছে সেগুলোর প্রায় সবকটি ওষুধই মানবদেহের জন্য টক্সিক বা বিষাক্ত ছিল। পুষ্টিকর কিংবা সুস্বাদু উপাদানসমুহ খাদ্য হিসাবে জনপ্রিয় হলেও রোগ চিকিৎসার জন্য বিষাক্ত এবং তিক্ত উপাদানই ওষুধ হিসাবে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছিল। ঐ সকল বিষাক্ত উপাদানগুলোর ক্ষতিকারক বিষক্রিয়াকে এড়িয়ে কেবলমাত্র আরোগ্যকারী গুণাবলীকে ব্যবহার করার প্রথম উপায় হিসাবে লঘুকরণ বা তীব্রতা কমিয়ে নেওয়াকেই নিরাপদ ওষুধ প্রয়োগ পদ্ধতি হিসাবে স্বীকৃতিলাভ করে। বিশেষ করে হোমিওপ্যাথিতে এই পদ্ধতি প্রথম প্রচলিত হয় যা ডাইলিউশন নামে পরিচিত। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে টিকাদান প্রক্রিয়ায় এই পদ্ধতিটি বিশেষভাবে পরীক্ষিত এবং গৃহীত হয়েছে।
(খ) বিষাক্ত ওষুধের সুস্বাদুকরণ : এরপর আর একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, ওষুধের যে কোন উপাদান বেশীমাত্রায় ইনজেকশনের দ্বারা প্রয়োগ করলে যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়, অল্পমাত্রায় এবং মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে সুস্বাদু করে মুখে খাইয়ে প্রয়োগ করলে অপেক্ষাকৃত কম কিংবা বিনা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সেই উদ্দেশ্য সাধন করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, ওরস্যালাইন এর বিষয়টি উলে¬খ্য। যে লবণ পানির মিশ্রণকে ইনজেকশন ব্যতীত মুখে পান করালে দেহ সহজে গ্রহণ করতে চাইত না এবং ইনজেকশনের দ্বারা প্রয়োগ করলে এ্যালার্জিজনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিত, সেই মিশ্রণে অল্প পরিমাণে চিনি মিশিয়ে সুস্বাদু করে দিলে দেহ তা বিনা বাধায় গ্রহণ করে থাকে। এই সামান্য আবিষ্কারটুকু ডায়ারিয়ার চিকিৎসায় বিপ¬ব ঘটিয়েছে। এই আবিষ্কারের শতশত বছর আগে থেকে আয়ুর্বেদশাস্ত্রীগণ বিবিধ বিষাক্ত বা টক্সিক ওষুধকে মধু এবং চাউল ধোয়া পানির সাথে মিশিয়ে খলে মাড়িয়ে সেবন করিয়ে এসেছেন। তারপর ইউনানী চিকিৎসাপন্থীরা প্রতিটি ওষুধকে শর্করা সহযোগে সুমিষ্ট করে রোগীদেরকে সেবন করান। তেমনি হোমিওপ্যাথিতেও শর্করা কিংবা দুগ্ধশর্করা (ল্যাকটোজ) এবং এ্যালকোহলের সঙ্গে মিশিয়ে ওষুধ প্রয়োগবিধি প্রচলিত রয়েছে, যার সঠিক উপকারীতার কারণ তৎকালীন প্রাচীনপন্থী গবেষকবৃন্দ উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেও হাতে কলমে পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণ করতে সক্ষম হননি, যার সঠিক ব্যাখ্যা আমরা আজ পাচ্ছি ওরস্যালাইনের গবেষণার মাধ্যমে।

(গ) ইনজেকশনের পরিবর্তে মুখে খাইয়ে ওষুধ প্রয়োগ পদ্ধতি : ইনজেকশনের পরিবর্তে মুখে সেবন করানোর ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে এড়ানো সম্ভব হয়েছে পোলিও টিকার বেলায়। ইনজেকশনের দ্বারা প্রয়োগ করার ফলে পোলিওতে আক্রান্ত হবার মত দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে গেছে অনেক শিশু। টিকা আবিষ্কারের প্রথম অবস্থায় বসন্ত এবং যক্ষ্মারোগের টিকা প্রয়োগের সময় অধিক পরিমানে টিকায় ব্যবহৃত উপাদানকে দেহে প্রয়োগ করা হত, যার ফলে অনেক সুস্থ মানুষ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। পরে ধীরে ধীরে সেই পরিমাণকে কমিয়ে আনার ফলে আজকাল আর সেই দূর্ঘটনা ঘটছেনা। এই লঘূকরণ পদ্ধতির নাম এ্যাটেনুয়েশন, যা অর্জন করতে অনেকদিনের ট্রায়াল এ্যান্ড এরর বা ভুল শোধরানো পর্যন্ত পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার পদ্ধতিতে গবেষণার প্রয়োজন হয়েছিল। প্রসংগতঃ ইমিউনোথেরাপিতে ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি প্রচেষ্টার দৃষ্টান্ত উলে¬খ করা চলে। ক্যান্সারজাতীয় টিউমারের ভিতর থেকে ইনজেকশনের সাহায্যে গৃহীত রস একই রোগীর দেহে প্রয়োগ করে ক্যান্সার রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা, যা সাফল্যলাভে ব্যর্থ হয়েছে।

অথচ হোমিওপ্যাথিতে একই পদ্ধতিতে ক্যান্সার রোগীর ক্ষত থেকে নিঃসৃত রস দিয়ে তৈরী ক্যান্সার টক্সিনকে প্রক্রিয়াজাত করে কার্সিনোসিন ও স্কিরিনাম নামক দুটি ওষুধ তৈরী করা হয়েছে যাকে সুক্ষ্মমাত্রায় সুস্বাদু করে মুখে খাইয়ে বংশগতভাবে প্রাপ্ত ক্যান্সার প্রবণতা কিংবা ক্যান্সার সদৃশ জটিল রোগপ্রবণতাকে প্রতিহত করা সম্ভব হচ্ছে। যদিও এই পদ্ধতিতে ক্যান্সার আরোগ্য করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া আধুনিক ইমিউনোথেরাপিতে বিসিজি টিকায় ব্যবহৃত যক্ষ্মারোগের জীবাণুকে ক্যান্সার আরোগ্য করার ব্যাপারে ইনজেকশনের দ্বারা প্রয়োগ করে অতি সীমিত সাফল্য অর্জিত হয়েছে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং অনিশ্চিত (তথ্য সূত্র নং ৩, পৃঃ নং ৯৫২)। অথচ হোমিওপ্যাথগণ যক্ষ্মার জীবাণু থেকে তৈরী টিউবারকুলিন নামক ব্যাকটেরিয়াল এন্ডোটক্সিন বা জীবাণু নিঃসৃত বিষকে সুক্ষ্মমাত্রায় সুস্বাদু করে মুখে সেবন করিয়ে অসংখ্য জটিল ইমিউনোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার থেকে সৃষ্ট রোগ যেমন হাঁপানি, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, জরায়ুর ফাইব্রয়েড, ওভারির সিষ্ট, ডায়াবেটিক গ্যাংগ্রীণ, বার্জারস ডিজিজ, সোরায়সিস, আপ্লাষ্টিক এ্যানিমিয়া, মেডুলোব্লাটোমা (ব্রেন টিউমার), ইত্যাদি রোগকে অবলীলাক্রমে সুস্থ করে আসছেন (তথ্য সূত্র নং ৩, পৃঃ নং ৬৫৫ এবং তথ্য সূত্র নং ১২, পৃঃ নং …..) ।

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় অর্জিত এসব আরোগ্যের সংবাদ বিজ্ঞ এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদেরকে আস্থাশীল করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে অথবা বিষয়টি আদৌ তাদের কর্ণগোচর করা হচ্ছে না। এর ফলে একটি অতি সহজ এবং কম ব্যয়বহুল স্বাস্থ্য প্রযুক্তির সুবিধা থেকে মানবজাতি বঞ্চিত হচ্ছে। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, প্রায় সর্বপ্রকার জটিল রোগের পিছনে দায়ী হচ্ছে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার উৎস মজ্জার দুর্বলতা জনিত সৃষ্ট নানাবিধ বিশৃঙ্খলা। সেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে সক্ষম যে সকল উপাদান জগতে রয়েছে সেগুলোকে সুস্বাদু করে এবং সীমিত বা স্বল্পমাত্রায় ইনজেকশনের পরিবর্তে মুখে খাইয়ে প্রয়োগ করলে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী ক্রিয়া অর্থাৎ মজ্জার শক্তিবর্ধন করে বিশৃঙ্খলা সমূহকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন প্রাচীন এবং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রযুক্তি সমূহের সমন্বয়সাধন, যা বয়ে আনতে পারে মানবজাতির জন্য অপার কল্যাণ, যেমনটি হয়েছে ওরস্যালাইনের বেলায়। উপরোক্ত প্রাচীন ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের তথ্য সমূহকে বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, সংক্রামক রোগের বেলায় যেমন টিকাদান পদ্ধতির দ্বারা দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে উজ্জীবিত করে রোগ প্রতিহত করা যায়, তেমনি পূর্বে বর্ণিত রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলার সুযোগে দেহের মধ্যে অযাচিতভাবে আশ্রয়প্রাপ্ত রোগবিষ বা এ্যান্টিজেনসমূহকে ধবংস করার জন্য বাছাই করা প্রাকৃতিক বিষাক্ত ভেষজ দ্বারা দেহের অস্থিমজ্জাকে এবং শ্বেতকণিকা সমূহকে উদ্দীপিত করে সুস্থ দেহকোষের ক্ষতিসাধন না করে নির্ভূলভাবে কর্মক্ষম এ্যান্টিবডি বা রোগবিষনাশক রোগপ্রতিরোধ বাহিনী তৈরী করানো সম্ভব। এই কাজে ইনজেকশনের পরিবর্তে সূক্ষ্মমাত্রায় মুখে খাওয়ানোর উপযোগী, সুস্থ দেহে রোগ তৈরী করতে সক্ষম নানাবিধ বিষাক্ত উপাদানকে ব্যবহার করাই সর্বোত্তম উপায়।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান